বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার স্টেশন
মহড়ায় হাঁকডাক কাজে শূন্য
- আপলোড সময় : ২৩-১০-২০২৫ ০৩:২০:৩৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৩-১০-২০২৫ ০৩:২০:৩৫ অপরাহ্ন
* অন্যদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে বেবিচক
* শাহজালাল বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিকে মান কমার শঙ্কা
বছরের পর বছর মহড়ায় দক্ষতা দেখিয়ে বাহবা কুড়ালেও বাস্তবে ব্যর্থতার মুখে পড়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিজস্ব ফায়ার ইউনিট। মাত্র ২৮০ মিটার দূরত্বের আগুনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তারা। শুরুতে এই আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এড়ানো যেতো শত শত কোটি টাকার ক্ষতি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিদুর্ঘটনায় নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে রানওয়ের পাশে বছরে বেশ কয়েকবার মহড়ার আয়োজন করে বেবিচক। এ মহড়ায় অংশ নিয়ে নিজেদের কসরত দেখান বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা। মহড়া শেষে করতালিতে বাহবা দেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বাস্তবে যখন বিমানবন্দরটির কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে তখন তারা আর পেরে ওঠেননি।
যদিও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা এবং বেবিচক চেয়ারম্যানের দাবি, আগুন লাগার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার কর্মীরা। তবে প্রশ্ন উঠেছে, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে যদি ঘটনাস্থলে ফায়ার কর্মীরা পৌঁছে থাকেন, তাহলে তারা কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেন না? ৩০ সেকেন্ডে তো পুরো কার্গো ভিলেজে আগুন ছড়ানোর কথা নয়। আবার এটি বড় কোনো বিস্ফোরণের ঘটনাও নয়, যেটা মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের গাফিলতি ও অদক্ষতার কারণে ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি। আবার বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সংশ্লিষ্টদেরও দায় কম নয়। কারণ, কার্গো ভিলেজের সামনের অ্যাপ্রোনে আমদানি করা শত শত টন মালামাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল বিমান। ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কার্গো ভিলেজের কাছে যেতে পারেনি। যদিও পাইপ দিয়ে অনেক দূরের আগুনও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
গত শনিবার শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। প্রায় ২৭ ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বলে। আগুন নেভাতে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যরাও আগুন নেভাতে যোগ দেন। ভয়াবহ এই আগুনের কারণে কিছু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল ও অন্য বিমানবন্দরে অবতরণও করাতে হয়েছে। আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে লাগা আগুনে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ আমদানিকারকদের পণ্য সামগ্রীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং তথা উড়োজাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানো এবং সরবরাহের কাজটি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এরই অংশ হিসেবে তারা কার্গো ভিলেজ এবং এর সামনে অ্যাপ্রোনে মালামাল স্তূপ করে রাখে। এর মধ্যে গত শনিবার দুপুর ২টায় কার্গো ভিলেজের ভেতরে আগুন লাগে। তখন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের (এটিসি) মাধ্যমে বার্তা যায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনে। নির্দেশনা পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায় দুটি ইউনিট (প্রতিটি ইউনিটে ছয়জন করে সদস্য)। তবে অ্যাপ্রোনে অগোছালোভাবে রাখা পণ্যের স্তূপের কারণে তারা উৎসের কাছে গিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ পায়নি। দূর থেকে পানি ছিটিয়ে লাভ হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের দুজন ফায়ার কর্মী জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরে মোট চারটি পানির গাড়ি আছে। এর মধ্যে একটি অকেজো। তাই যখন কার্গোতে আগুন লাগে, তখন বিমানবন্দরে ফ্লাইটও ওঠা-নামা করছিল। তাই দুটি গাড়ি নিয়ে তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু যেখানে ফায়ারের গাড়ি রাখা হয়েছে, সেখান থেকে আগুনের উৎস পর্যন্ত পাইপ ঘুরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। অর্থাৎ, এত লম্বা পাইপ গাড়িতে ছিল না। তাই বাইরে থেকে ছড়িয়ে সঠিক জায়গায় পানি পৌঁছানো যায়নি। এর মধ্যে বাতাসে আগুন চারপাশে ছড়াতে থাকে। আবার বিমানবন্দর চালু থাকায় বাকি একটি গাড়িও এখানে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি অন্তত দুটি ফায়ার গাড়ি সবসময় প্রস্তুত রাখতে হয়। এর কিছু সময় পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বিমানবন্দরে প্রবেশের চেষ্টা করে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নানান অব্যবস্থাপনার কারণে তারা আগুন নেভাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। আবার বিমান দ্রুত পণ্যগুলো সরিয়ে দিতে পারলে কাছাকাছি গিয়ে পানি ছিটানো যেতো। তাহলে আগুন এত ছড়িয়ে পড়তো না, এত ক্ষয়ক্ষতিও হতো না।
নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যাওয়ার ১০ মিনিট পরে যায় বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিট। এরপর সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। আগুন নেভাতে ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা কাজ করে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর চালু হয়। আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি বিমানের কার্গো পরিদপ্তরের পরিচালক শাকিল মেরাজ।
তবে গত রোববার বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম বলেন, ওই ঘটনায় বিমান একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে কারও গাফিলতি থাকলে তা তদন্তে উঠে আসবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের তিনদিন পর গত মঙ্গলবার বেবিচকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুরো বিষয় তুলে ধরেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক। তবে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি কমপ্লেক্সে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তার কোনো দায় নেননি তিনি।
মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিকের ভাষ্য, কার্গো ভিলেজটি বেবিচকের হলেও এটির কার্যক্রম পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং) এজেন্ট ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সেখানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে আছে বিমান। আর মালামালগুলো ক্লিয়ার করার দায়িত্ব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের। এছাড়া সেখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এগুলো ম্যানেজ করার দায়িত্ব তাদের। তবে তদন্তের আগে কাউকে দায় দিতে চান না মন্তব্য করে তিনি বলেন, তদন্ত যেহেতু চলছে, এটা শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা ঠিক নয়। আমি কারও দিকে আঙুল তুলতে চাই না।
বেবিচক চেয়ারম্যান কারও দিকে আঙুল তুলতে না চাইলেও তার নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের সক্ষমতা কতটুকু আছে সে বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো বারবার এড়িয়ে যান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ওই এলাকায় (কার্গো ভিলেজ) প্রায় ১৪০টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল। আমরা কাগজপত্রে প্রমাণ পেয়েছি, নিয়মিত ফায়ার সেফটি কার্যক্রম চলতো। শুধু জুন মাসেই প্রায় ২০০ জন কর্মীকে ফায়ার ড্রিল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে একদিন আমরা ফায়ার ড্রিল অনুশীলন করি। এটি সাধারণত বিমান সংক্রান্ত দুর্ঘটনা বা আগুনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য করা হয়। এর বাইরে প্রতিদিন আমাদের ফায়ার টিম বিভিন্ন সেকশনে গিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালায়।
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ওইদিন রাতেই সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এই কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে (২৩ অক্টোবর) প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এই কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি এবং কার কী দায়দায়িত্ব ছিল তা নির্ধারণ করবে।
অন্যদিকে ঘটনা তদন্তে গত সোমবার পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। কমিটির সদস্যদের ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া গত রোববার বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। সবকটি কমিটি তাদের তদন্ত কাজ চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) সদস্য। এ সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচলে মান ও নিয়ম তৈরি এবং বাস্তবায়ন করে। এর মধ্যে রয়েছে বিমান চলাচল, নিরাপত্তা ও পরিবেশগত মান। এছাড়া দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলকে আরও নিরাপদ ও দক্ষ করতে কাজ করে সংস্থাটি। কানাডার মন্ট্রিলে এ সংস্থার সদর দপ্তর অবস্থিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আইসিএও নিয়ম অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে সব ধরনের আগুন নির্বাপণের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে সেটা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বিমানবন্দরটি আইসিএও’র গ্রেডে মান হারাবে।
তবে এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনার পর আমরা কী পদক্ষেপ নিয়েছি আইসিএও এটা দেখবে। আমাদের করণীয় নিয়ে হয়তো দিকনির্দেশনা দেবে। কিন্তু এর মাধ্যমে বিমানবন্দরটির গ্রেড বা মান কমবে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার